ক্রিয়েটিনিন লেভেল ও কিডনি রোগ। #ক্রিয়েটিনিন এর স্বাভাবিক লেভেল # ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স রেট#ক্রিয়েটিনিন লেভেল বৃদ্ধির কারণ#ক্রিয়েটিনিন লেভেল বাড়লে কোন ফল খাবে না#

 




মানুষের শরীর বৃত্তীয় কাজ স্বাভাবিক রাখার জন্য কিডনি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিডনির স্বাভাবিক কার্যকারিতার উপর নির্ভর করে, মানব দেহের অন্যান্য অঙ্গের স্বাভাবিক কার্যকারিতা। রেচনতন্ত্রের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনী। কিডনির কার্যকারিতা স্বাভাবিক আছে কিনা সেটা দেখার জন্য সর্বপ্রথম পরীক্ষা হচ্ছে ক্রিয়েটিনিন লেভেল।

"ক্রিয়েটিনিন"একটি বহুল আলোচিত কিডনি রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা।






সেরাম ক্রিয়েটিনিন খুবই পরিচিত রক্ত পরীক্ষা। নিয়মিত রক্ত পরীক্ষার ক্ষেত্রে ডাক্তাররা প্রায়ই এই পরীক্ষাটি করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিডনির কার্যকারিতা দেখার জন্য পরীক্ষাটি করা হয়।





ক্রিয়েটিনিন লেভেল বাড়লে কি হয়???


 ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে কিডনি ঠিকমত কাজ করছে না। ক্রিয়েটিনিন কমানোর কোনো ওষুধ নাই। মূলত কিছু বিশেষ রোগ হলে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যায়। যেসব রোগের কারনে ক্রিয়েটিনিন বাড়ে সেসব রোগের চিকিৎসা করালেই ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।





ক্রিয়েটিনিন কি??




ক্রিয়েটিনিন এক ধরনের বর্জ্য, যেটি মাংসপেশির কোষ ভেঙে তৈরি হয়। এটি শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যখন ক্রিয়েটিনিন উৎপন্ন হয় তখন রক্তের সঙ্গে তা মিশে যায়। 




ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স রেট




রক্ত যখন কিডনির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন কিডনি এই রক্ত ছেঁকে ক্রিয়েটিনিন প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়। তাই রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নির্ণয় করলে বোঝা যায় কিডনি কতখানি কর্মক্ষম আছে। ক্রিয়েটিনিন বের করে দেওয়ার এই ক্ষমতা ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স রেট নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে কিডনি গঠণের একক গ্লোমেরুলাস কতখানি কাজ করতে পারছে তাও বের করা যায়। এটি গ্লোমেরুলাস ফিলট্রেশন রেট বা জিএফআর নামে পরিচিত।






কিডনি আসলে একটি ছাঁকনির মতো। নেফ্রন নামের কিডনির কোষগুলো একেকটা ছাঁকনির কাজ করে। কিডনিতে থাকে হাজার হাজার ক্ষুদ্র রক্তনালি, নেফ্রনের ভেতরেও এসব নালি বিস্তৃত থাকে। এসব রক্তনালির মধ্য দিয়ে রক্ত চলাচল করার সময় কিডনি ছাঁকনির কাজটি করে। শরীরের জন্য ক্ষতিকর পদার্থগুলো এভাবেই কিডনি ছেঁকে আলাদা করে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়।

প্রতি মিনিটে কিডনি যতটা রক্ত থেকে ক্রিয়েটিনিন বের করে দিতে পারে সেটাই ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স রেট।







 প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে এ হার ১২৫ মি.লি.। এর অর্থ প্রতি মিনিটে কিডনি ১২৫ মি.লি. রক্ত থেকে সম্পূর্ণভাবে ক্রিয়েটিনিন বের করে দিতে সমর্থ। বয়স, লিঙ্গ ও শরীরের আকৃতির ওপর নির্ভর করে এই হার।




কিডনির কার্যকারিতা  ও ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স



কিডনির কার্যকারিতা নির্ণয়ের জন্য ডাক্তাররা ক্রিয়েটিনিন ও ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করিয়ে থাকেন। কিডনির কার্যকারিতা যত কমবে ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স তত কমবে। কিডনির কার্যকারিতা নির্ণয়ের জন্য এই টেস্ট দুভাবে করা যায় । এক. ২৪ ঘণ্টার প্রস্রাব সংগ্রহ করে তাতে ক্রিয়েটিনিনের উপস্থিতি কতটা আছে তা নির্ণয় করে। দুই. শিরা থেকে রক্ত সংগ্রহ করে তা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা। এ ক্ষেত্রে রক্তে যত বেশি ক্রিয়েটিনিন থাকবে কিডনির কার্যকারিতা তত কম বলে ধরা হবে।

ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স রেট দিয়ে কিডনির অসুখ নির্ণয় করা হয়। কিডনির কার্যকারিতা কমে যায় আকস্মিক বা অ্যাকিউট, দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক_এই দুভাবে। বারবার ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করে রোগ এবং কিডনির সর্বশেষ অবস্থা বোঝা যায়। তবে মনে রাখতে হবে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গেও কিডনির কার্যকারিতা একটু কমে যায়।






কিডনির কার্যকারিতা ৫০ ভাগ নষ্ট হওয়ার আগে অনেক ক্ষেত্রেই রোগী টের পান না। কারণ বেশির ভাগ সময়ই কোনো লক্ষণ থাকে না। এ কারণে প্রত্যেকেরই মাঝেমধ্যে ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্টটি করা দরকার।



 ক্লিয়ারেন্স স্টেজ ----ক্রিয়েটিনিন


এই টেস্টটিতে সাধারণত পাঁচটি স্টেজ হিসেবে দেখানো হয়।




স্টেজ ১: 

ক্লিয়ারেন্স রেট ৯০ বা তার বেশি হলে কিডনির কার্যকারিতা স্বাভাবিক।



স্টেজ ২: রেট ৬০-৯০ এর মধ্যে হলে কিডনির কার্যকারিতা মৃদু ক্ষতিগ্রস্ত।



স্টেজ ৩: রেট ৩০-৫৯ এর মধ্যে হলে কিডনির কার্যকারিতা মাঝারি ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত।




স্টেজ ৪: রেট ১৫-২৯ এর মধ্যে হলে কিডনির কার্যকারিতা তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।



স্টেজ ৫: রেট ১৫-এর নিচে হলে কিডনি অকার্যকর, ডায়ালিসিস প্রয়োজন।




এজন্য ক্রিয়েটিনিন বেড়ে গেলে আগে সংশ্লিষ্ট রোগের চিকিৎসা করাতে হবে। 




যেমন:

১. ডায়াবেটিস থেকে ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি রোগ হয়। এতে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।



২. ব্লাডপ্রেসার বা রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রায় না থাকলে কিডনি রোগ হতে পারে। সেক্ষেত্রে ব্লাডপ্রেসার বা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।



৩. কিডনিতে সংক্রমণের দরুন গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস রোগ হতে পারে। এই রোগের কারনে থেকে ক্রনিক কিডনি ডিজিস (CKD) হতে পারে। সেক্ষত্রে গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস রোগের চিকিৎসা করাতে হবে।




ক্রিয়েটিনিন লেভেল বৃদ্ধির কারণ


‌>বিভিন্ন সম্পূরক, ওষুধ এবং খাবারে অস্থায়ীভাবে রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বাড়াতে পারে


>প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন এবং লাল মাংস খাওয়া


>কঠোর বা ভারী ব্যায়াম করা


>কিডনি বৈকল্য এবং সংক্রমণ




কিছু কিছু রোগ কিডনিকেও প্রভাবিত করে যার ফলে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেশি থাকে:

 



>গাউট


>ডায়াবেটিস


>Rhabdomyolysis বা পেশীবহুল ডিস্ট্রোফির কারণে অস্বাভাবিক পেশী ভাঙ্গন।


>উচ্চ্ রক্তচাপ


>মূত্রনালীর সংক্রমণ


অটোইমিউন ডিসঅর্ডার, যেমন লুপাস


>গুডপাসচার (goodpustar syndrome)সিন্ড্রোম


>শক দ্বারা সৃষ্ট রক্তক্ষরণ






ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে গেলে করণীয়:





১. ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে গেলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা নিতে হবে। চিকিৎসা যত দ্রুত নেয়া হবে তত ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব হবে।



২. তরুণ-তরুণীরা যদি কিডনি রোগী রোগে আক্রান্ত হয় এবং তাদের ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেশি থাকে তবে কিডনি প্রতিস্থাপন (ট্রান্সপ্লান্ট) করাটাই তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা।



৩.বয়স্ক এবং একাধিক রোগে আক্রান্তদের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কন্টিনিউয়াস অ্যামবুলেটরি পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস (CAPD) করাটাই উত্তম।



৪.মাঝ বয়সী এবং কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করাতে অক্ষম রোগীদের ক্ষেত্রেও ডায়ালাইসিস-ই ভালো চিকিৎসা।



৬০ বছরের বেশি বয়সীদের রক্তে ক্রিয়েটিনিন লেভেল অনেক সময়ই ঠিক থাকে; কিন্তু ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স রেট কমে যায়। তা ছাড়া যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ আছে তাদেরও এই রেট কমতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যেই এ টেস্টটি করে কিডনির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া উচিত।


ক্রিয়েটিনিন লেভেল বাড়লে কোন ফল খাবে না


অসুস্থ কিডনি অনেক সময় রক্ত থেকে পটাশিয়াম নিষ্কাশন ঠিকমতো করতে পারে না। এতে রক্তে পটাশিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায়। মাঝেমধ্যে রক্তে ইলেকট্রোলাইট পরীক্ষা করা হলে বিষয়টা ধরা পড়ে। যাদের এই প্রবণতা আছে তারা উচ্চ পটাশিয়ামযুক্ত ফলমূল এড়িয়ে চলাই ভালো। বেশি পটাশিয়াম আছে কলা, কমলা, ডাব, তরমুজ, টমেটো, কিশমিশ, অ্যাভোকেডো ইত্যাদি ফলে। তবে পটাশিয়ামের পরিমাণ কম এমন ফল যেমন আপেল, আঙুর, আনারস, স্ট্রবেরি ইত্যাদি খেতে বাধা নেই।




* কিডনি সমস্যায় অনেক সময় ফসফরাস বা ফসফেটের পরিমাণও যায় বেড়ে। ভুট্টার তৈরি খাবার, কোলা-জাতীয় পানীয়, কিছু বাদামে ফসফেটের পরিমাণ বেশি। তবে চিকিৎসক চাইলে ফসফেট বাইন্ডার ওষুধের মাধ্যমে ফসফরাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।




* কিডনি রোগীদের ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ‘ডি’র অভাব দেখা দেয়, রক্তস্বল্পতা হয়। তাই ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি ও আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।




ক্রিয়েটিনিন এর স্বাভাবিক লেভেল


(0.6--1.3)mg/dl

Post a Comment

5 Comments