ই পি আই--সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি & কোভিড ভ্যাকসিনেশন/শিশুকে কোন বয়সে কোন টিকা দিতে হবে?

 

ই পি আই--সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি & কোভিড ভ্যাকসিনেশন





ইপিআই একটি বিশ্বব্যাপী কর্মসূচি, যার মূল লক্ষ্য সংক্রামক রোগ থেকে শিশুদের অকালমৃত্যু প্রতিরোধ করা। ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির ঘোষণা ও বাস্তবায়নের পর থেকে দেশে এক বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু প্রতিরোধ করতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) সফলতা আজ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত এবং সমাদৃত। 


সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর সবার মাঠ-পর্যায়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই বাংলাদেশে আজ গড়ে ৯০ শতাংশের ওপরে শিশুকে নিয়মিত টিকা দেয়া সম্ভব হয়েছে। ফলে শিশুমৃত্যুর হার আজ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। 




টিকাদান কর্মসূচির ফলে প্রতিরোধযোগ্য রোগসমূহ; যেমনÑযক্ষ্মা, পোলিও মাইলাইিটস, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, মা ও নবজাতেকর ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি জনিত রোগসমূহ, হাম, রুবেলা, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া প্রভৃতি অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।





 বর্তমান বিশ্বে রোগ প্রতিরোধের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, কারণ রোগ প্রতিকারের চেয়ে রোগ প্রতিরোধই উত্তম। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। ফলে শিশুরা সহজে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। টিকা একটি নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। মূলত টিকার উদ্দেশ্য হলো জীবাণু বা তার নির্দিষ্ট কোনো অংশকে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া, যেন পরবর্তী সময়ে সেই জীবাণু শরীরে ঢুকলে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সহজেই তা শনাক্ত করে রোগ প্রতিরোধ করতে পারে।




সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি শুরু করার আগে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় আড়াই লাখ শিশু ৬টি রোগে মারা যেত। এর মধ্যে এক বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। দেখা গেছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের রোগ ও মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এদের তিন ভাগের এক ভাগ মারা যায় ডায়রিয়া রোগে, এক ভাগ ছয়টি প্রতিরোধযোগ্য রোগে এবং বাকি এক ভাগ অন্যান্য রোগে। তাই সময়মতো টিকা প্রদান করে শিশুদের মৃত্যুহার অনেকাংশেই কমানো সম্ভব। এ জন্য সঠিক সময়সূচি অনুসরণ করে এবং ন্যূনতম বিরতি মেনে টিকা প্রদান করলে অনেক রোগ থেকে শিশুদের বাঁচানো সম্ভব হয়। অবশ্য টিকা কখন দেয়া যাবে, আর কখন দেয়া যাবে না, এ সম্পর্কে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি এবং এ বিষয়টি সম্পর্কে জনসচেতনতা বিশেষ প্রয়োজন।




যক্ষ্মা প্রতিরোধে ইপিআই অন্তর্ভুক্ত যে টিকা দেয়া হয়, তার নাম বিসিজি। বিসিজি জন্মের পরপরই এক ডোজ দিতে হয়।



 ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস-বি এবং হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি এই পাঁচটি রোগ প্রতিরোধে পেন্টাভ্যালেন্ট নামক একটি টিকা দেয়া হয়। এটার ডোজ ৩টি। প্রথম ডোজ ৬ সপ্তাহ বয়সে, এরপর কমপক্ষে ৪ সপ্তাহ ব্যবধানে বাকি ২টি ডোজ অর্থাৎ ৬, ১০, ১৪ সপ্তাহে, সব মিলে ৩টি ডোজ টিকা দেয়া হয়।




 নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া প্রতিরোধে নিউমোকক্কাল কনজুগেট ভ্যাকসিন ও ৩ ডোজে দেয়া হয়। প্রথম ডোজ ৬ সপ্তাহ বয়সে, এরপর কমপক্ষে ৪ সপ্তাহ ব্যবধানে বাকি ২টি ডোজ, অর্থাৎ ৬, ১০, ১৪ সপ্তাহে সব মিলে ৩টি ডোজ দেয়া যেতে পারে। 



ইপিআইয়ের একমাত্র মুখে খাওয়ার ভ্যাকসিন হলো ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন, যা পোলিও প্রতিরোধে দেয়া হয়। প্রথম ডোজ ৬ সপ্তাহ বয়সে, এরপর কমপক্ষে ৪ সপ্তাহ ব্যবধানে পরবর্তী ২টি ডোজ, অর্থাৎ ১০ ও ১৪ সপ্তাহে দেয়া হয়। এর চতুর্থ ডোজটি ৯ মাস বয়সে হামের টিকার সঙ্গে দেয়া হয়। 



এছাড়া জন্মের ১৪ দিনের মধ্যে ওরাল পোলিও ভ্যাকসিনের অতিরিক্ত ডোজ দেয়া যেতে পারে। তাছাড়া বর্তমানে ইনজেকশনের মাধ্যমেও পোলিও ভ্যাকসিন দেয়া হয়, যা ইপিআইয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি ৬ সপ্তাহ ও ১৪ সপ্তাহে দেয়া হয়।


 শিশুর ৯ মাস পূরণ হলে হাম ও রুবেলার টিকা দেয়া হয়। একইসঙ্গে তাকে পূর্বে উল্লিখিত ওরাল পোলিও ভ্যাকসিনের চতুর্থ ডোজও দেয়া হয়। 


সব শেষে ১৫ মাস বয়সে হামের টিকার আরেকটি ডোজ দেয়া হয়। 



এ ছাড়া মেয়েদের ধনুষ্টংকার প্রতিরোধেও ৫টি ধনুষ্টংকারের টিকা দেয়া হয়। এ টিকার প্রথম ডোজ নেয়ার ১ মাস পর দ্বিতীয় ডোজ, তার ৬ মাস পর তৃতীয় ডোজ, তার ১ বছর পর চতুর্থ ডোজ, তারও ১ বছর পর পঞ্চম ডোজ নিতে হবে।





সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কার্যক্রমসমূহ সঠিকভাবে সম্পন্ন করার বিষয়ে মাঠ কর্মীদের অনেক দায়িত্ব। সঠিক বয়সে, সঠিক বিরতিতে ও সঠিক টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে মা-বাবা, অভিভাবকদের পরামর্শ প্রদানের পাশাপাশি কর্মসূচির সঠিক বাস্তবায়ন, অগ্রগতি পর্যালোচনা, পর্যালোচনা শেষে সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি, যা অভিভাবকদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যমে ইপিআই কর্মসূচির লক্ষ্যকে সফল করতে পারে। প্রচার অভিযানের মাধ্যম ও উপকরণ হিসেবে ফ্লিপ চার্ট, মাইকিং, গান ও কবিতার স্লাইড প্রদর্শনী, আলোচনা এবং মিটিং জোরদার করতে হবে ও হাটবাজারে বা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পোস্টার লাগালে প্রচার কাজকে আরও ফলপ্রসূ ও বেগবান করবে। আর এসব প্রচারাভিযানে স্থানীয় বিভিন্ন নেতা যেমন:শিক্ষক, ইমাম, চেয়ারম্যান, মেম্বার, শিল্পী সাহিত্যিক, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী, মহিলা সংস্থা বা ক্লাবের কর্মীদের অংশগ্রহণ বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, ইপিআই কর্মসূচিতে সামাজিক সমর্থন, ইপিআই কাজে সহায়তা, তত্ত্বাবধান ও মনিটরিং এবং টিকাদান কর্মীর দায়িত্ব ও করণীয় বিষয়সমূহের সফল বাস্তবায়নই পারে কাক্সিক্ষত সুস্থ, সবল, সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করতে।





বর্তমানে কভিড মহামারি প্রতিরোধে ১২ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়স্কদের টিকা প্রদান করা হচ্ছে। 


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বিষয়টি তদারক করছেন। সারাবিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কীভাবে শিশুদের এ টিকার আওতায় আনা যায়, তা নিয়ে সরকার আন্তরিকভাবে পর্যালোচনা করছে। ২০২২ সালের শুরুতে স্কুলে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধনকালে তিনি শিশুদের সংক্রামক রোগগুলোর টিকাদান এবং কভিড থেকে শিশুদের কীভাবে সুরক্ষিত রাখা যায়, এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। সরকারই সব করে দেবে, বিষয়টি এমন নয়, আমাদের সাধারণ জনগণকেও সচেতন হতে হবে। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য এ নীতিকে বুকে ধারণ করে আমরা এগিয়ে যাব, একে অপরের সুখ-দুঃখের অংশীদার হবো, সবাই মিলেমিশে কাজ করব, সুস্থ সবল উন্নত জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াব এটাই আমাদের কাম্য।



যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাবে। অভ্যাস বা আচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থার আলোকে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনছে, যা মানুষকে উন্নত জীবনযাপনে উপকৃত করছে। স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনে মানুষের মনোভাব ও আচরণে পরিবর্তন যেমন জরুরি, তেমনি সেবা প্রদানকারী সংস্থার নিরলস পরিশ্রমের পাশাপাশি সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব তার নিজ এলাকার নিরক্ষর, অল্প শিক্ষিত, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা, যা গোটা জাতির উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। তাই টিকাদান কর্মসূচির সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করছে সাধারণ মানুষের সচেতনতায়। এখন প্রয়োজন শুধু আমাদের এগিয়ে আসা সহযোগিতার হাত এবং সচেতন মন নিয়ে।


Post a Comment

1 Comments