বাতজ্বর/rheumatic fever
বাতজ্বর একটি মারাত্মক রোগ। এ রোগে গিরাব্যথা, জ্বর এবং পরিশেষে হৃৎপিণ্ড আক্রান্ত হতে পারে। এ রোগে, গিরাব্যথা সাধারণত একটি গিরার মধ্যে সীমাবব্ধ থাকে না।
একটা গিরায় সাধারণত ২-৩ দিন ফোলা এবং ব্যথা থাকে, তারপর অন্য গিরা আক্রান্ত হয়। এক গিরা থেকে অন্য গিরা আক্রান্ত হওয়া রিউম্যাটিক ফিভার বা বাতজ্বরের প্রধান বৈশিষ্ট।
স্ট্রেপ্টোকোকাস ব্যাকটেরিয়া ( Group A streptococcus bacterium) সংক্রমণের ফলে এ রোগ হয়। ‘strep throat’ এর মত সংক্রমণের চিকিৎসা সময় মত না করালে তা শরীরের অন্যান্য অংশে (বিশেষ করে গিরায় ,গিরায়, ত্বকে, মস্তিষ্কে এবং হৃদপিণ্ডে) ছড়িয়ে যায়। যেকোন বয়সে এরোগ হতে পারে তবে শিশুদের মধ্যে বিশেষ করে ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের মধ্যে এরোগ বেশি হয়ে থাকে। সময়মত চিকিৎসা না করালে জীবাণু হৃদপিণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে।
বাতজ্বরের লক্ষণ
হঠাৎ করে লক্ষণ দেখা দেয়
* জ্বর
* গিরায়, গিরায় ব্যথা। বিশেষ করে হাটু, কনুই, কব্জি ইত্যাদি
* অবসাদ অনুভব করা
*গিরায় ,গিরায় ছোট ,ছোট ফুসকুড়ি দেখা দেয়
#শরীরে কম্পন হওয়া
#ওজন কমে যায়
#স্নায়ুবিক দুর্বলতা
#হৃৎপিণ্ডে সমস্যা হওয়া। হৃৎপিণ্ড বড় হয়ে যাওয়া। নাড়ির স্পন্দন (Pulse) বেড়ে যাওয়া
*ঊর্ধ্বশ্বাস হওয়া
#বুকে ব্যথা
*পেটে ব্যথা এবং ক্ষুধামন্দা
শিশুরা প্রায়ই বাতজ্বরে আক্রান্ত হয়
যদিও যেকোন বয়সেই বাতজ্বর হতে পারে তবুও, শিশুদের মাঝে এই আক্রান্ত হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। বিশেষকরে স্কুলবয়সী (৫-১৫ বছর) শিশুদের মাঝে এই রোগ বেশি দেখা দেয়। ৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের এবং বয়স্কদের মাঝে এ রোগ কম দেখা যায়।
বাতজ্বর হলে কি করতে হবে
শিশুদের গলাব্যথা, গিরায় ব্যথা এবং জ্বর হলে অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এ রোগের চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য হলো, রোগীর কষ্ট দূর করা, সত্বর আরোগ্য লাভে সাহায্য করা এবং মারাত্মক জটিলতার হাত থেকে রোগীকে রক্ষা করা। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ওষুধ রোগীকে খাওয়াতে হবে এবং সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে,
যতোদিন না গিরার ফোলা বা ব্যথার উপশম না হয় বা ইএসআর (E.S.R) স্বাভাবিক হয়। ব্যথাগ্রস্থ গিরা বা অস্থিসন্ধিকে এমন অবস্থায় রাখতে হবে যাতে রোগী সবচেয়ে আরাম পায়। ব্যথা কমে গেলে ধীরে * ধীরে হালকা ব্যায়াম আরম্ভ করা উচিত যাতে গিরা ও পেশি তাদের পূর্ণ শক্তি ফিরে পায়।
এ রোগ একবার হলে আবার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই রোগ ভালো হওয়ার পর প্রতিরোধের চিকিৎসা করা উচিত। মনে রাখবেন, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ হলো উত্তম। কেননা, এ রোগে হৃদপিণ্ডের ভালব নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
তাই ভালব যাতে নষ্ট না হয় তার জন্য প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা নেয়া উচিত। প্রতিরোধ চিকিৎসার সুফল পেতে হলে নিয়মিত চিকিৎসা চালানো একান্ত প্রয়োজন। কখনো তা বেশ কয়েক বছরের জন্য (যেমন-৫ বছর),
কখনো ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত, তবে ক বছর এ প্রতিরোধ চিকিৎসা চালাতে হবে তা আপনার শিশুর চিকিৎসকই নির্ধারণ করবেন। কখনো ,কখনো সামান্য গিরাব্যাথাকে অনেকে বাতজ্বর বলে মনে করে করেন। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা উচিত।
প্রতিরোধ চিকিৎসার সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন তা হলো স্বাস্থ্যকর বাসস্থান ও পরিবেশের নিশ্চয়তা। রিউম্যাটিক হৃদরোগ Rheumatic heart disease
ছোটবেলা থেকে দীর্ঘদিন একজনের বাতজ্বর বা রিউম্যাটিক ফেবার থাকলে তার রিউম্যাটিক হৃদরোগ Rheumatic heart disease হতে পারে। অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে বাতজ্বরে না ভূগলেও এ রোগ হতে পারে। বাতজ্বরের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি হলো রিউম্যাটিক হৃদরোগ।
এ রোগ হলে, হৃদপিণ্ডের ভাল্বসহ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে। এ রোগ হলে বুকে ব্যথা, শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। তবে কখনো, কখনো এরোগের কোন লক্ষণ ধরা পড়ে না।
বাতজ্বর চিকিৎসা
1. বিছানা বিশ্রাম: (জয়েন্টের ব্যথা কমায় এবং কার্ডিয়াক কাজের চাপ কমায়)
=>তক্ষণ না উপসর্গগুলি (জ্বর) এবং লিউকোসাইটের সংখ্যা এবং ESR স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এটি চালিয়ে যাওয়া উচিত।
রোগীরা তারপর স্বাভাবিক শারীরিক কার্যকলাপ ফিরে আসতে পারেন কিন্তু
যাদের কার্ডিটিস হয়েছে তাদের কঠোর ব্যায়াম এড়ানো উচিত।
2.বেনজিল পেনিসিলিন
1.2 m.U.
বা ফেনোক্সিমিথাইল পেনিসিলিন
10 দিনের জন্য 250 মিলিগ্রাম 6 ঘন্টায়।
3.অ্যাসপিরিন
: 60 মিলিগ্রাম/কেজি/দিন 6 ডোজ ছয় ডোজ বিভক্ত।
প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে, প্রতিদিন 100 মিলিগ্রাম/কেজি সহনশীলতার সীমা পর্যন্ত বা প্রতিদিন সর্বোচ্চ 8 গ্রাম প্রয়োজন হতে পারে।
ESR কমে না যাওয়া পর্যন্ত অ্যাসপিরিন চালিয়ে যেতে হবে এবং তারপর ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে।
সতর্কতা:
হালকা বিষাক্ততার মধ্যে রয়েছে বমি বমি ভাব, টিনিটাস এবং বধিরতা;
বমি, ট্যাকিপনিয়া এবং অ্যাসিডোসিস আরও গুরুতর।
4প্রেডনিসোলন
: কার্ডাইটিস, গুরুতর বাতের জন্য 1-2 মিগ্রা/কেজি/দিন;
ইএসআর স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত প্রেডনিসোলন (প্রতিদিন 1.0-2.0 মিলিগ্রাম/কেজি বিভক্ত মাত্রায়) চালিয়ে যেতে হবে, এবং তারপর বন্ধ করে দিতে হবে।
বাতজ্বর প্রতিরোধ
রোগীরা বাতজ্বরের আরও আক্রমণের জন্য সংবেদনশীল যদি অন্য স্ট্রেপ্টোকক্কাল সংক্রমণ ঘটে, এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রফিল্যাক্সিস দেওয়া উচিত-
বেনজাথিন পেনিসিলিন
-1.2 m.U i.m.
সম্মতি সন্দেহ হলে মাসিক,
বা
ফেনোক্সিমিথাইল পেনিসিলিন,
প্রতিদিন 250 মিলিগ্রাম 12 ঘন্টা
চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে
=>21 বছর বয়স পর্যন্ত যদি আর আক্রমণ না হয় বা
=>আক্রমণের 5 বছর পর (বয়স> 21 বছর)
অবশিষ্ট হৃদরোগ আছে যারা.
=>শেষ পর্বের 10 বছর পর পর্যন্ত বা
=>40 বছর বয়স পর্যন্ত, (যা পরে হয়):
দীর্ঘমেয়াদী অ্যান্টিবায়োটিক প্রফিল্যাক্সিস তীব্র বাতজ্বরের আক্রমণ প্রতিরোধ করে কিন্তু সংক্রামক এন্ডোকার্ডাইটিস থেকে রক্ষা করে না।
মনে রাখা দরকার
Streptococcus bacterial সংক্রমণের পর চিকিৎসা করা না হলে বা বিলম্ব হলে বাতজ্বর বা রিউম্যাটিক ফিভার হয়। বাতজ্বর বা রিউম্যাটিক ফিভার হলে যথাসময়ে চিকিৎসা না করালে রিউম্যাটিক হৃদরোগ Rheumatic heart disease হয়। বাতজ্বর বা রিউম্যাটিক ফিভার হলে সঙ্গে, সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
নানা ভ্রান্তি ও অসচেতনতা থেকে সাবধান
রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা নিয়ে রয়েছে নানা ভ্রান্তি ও অসচেতনতা। যেমন স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে রক্তে এএসও টাইটার বৃদ্ধি পায়। অনেক সময় এটি বৃদ্ধি পেলেই বলা হয় বাতজ্বর হয়েছে। কিন্তু এএসও টাইটার একটি সহায়ক পরীক্ষামাত্র।
অন্যান্য লক্ষণ না থাকলে এর বৃদ্ধিতে কিছু আসে-যায় না। বাতজ্বর ছাড়াও এএসও টাইটার বাড়তে পারে। যেমন: স্ট্রেপটোকক্কাসজনিত কিডনি রোগ, স্কারলেট জ্বর, নিউমোনিয়া, ইরাইসেপালাস এবং যেকোনো স্ট্রেপটোকক্কাস সংক্রমণ।
তাই এএসও টাইটার বেশি পেলেই আতঙ্কিত হবেন না। বাতজ্বর আছে কি না, তা নিশ্চিত হয়ে তবেই চিকিৎসা শুরু করুন। কেননা, এ রোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি।
বাতজ্বর হলে কী ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে?
বাতজ্বরের ফলে কখনো, কখনো দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা দেখা দিতে পারে যেমন:
বাতজ্বরের ফলে বাতজনিত হৃদ্রোগ হয়, যা থেকে হৃৎপিণ্ডের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। হৃৎপিণ্ডের ভালভের সমস্যা দেখা দেয়। বিভিন্ন জোড়া বা জয়েন্টে ব্যথা থাকে ও জয়েন্ট নষ্টও হয়ে যেতে পারে।
বাতজ্বর কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়
অস্বাস্থ্যকর ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ বা বস্তি এলাকায় বসবাসকারীদের মধ্যেই এই রোগ বেশি হয়ে থাকে। তাই এমন পরিবেশ এড়িয়ে চলা উচিত। ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যেমন খাবার পরে দাঁত-মুখ ভালো করে পরিষ্কার করা। বিশেষ করে রাতে শোয়ার আগে ও সকালে ঘুম থেকে উঠে ভালোভাবে দাঁত ব্রাশ করা। নিয়মিত পরিমিত পানি পান করা উচিত।
গলায় সংক্রমণ বা গলাব্যথা হলে অবহেলা না করে তাৎক্ষণিক সঠিক চিকিৎসা করলে বাতজ্বর হওয়ার সম্ভাবনা কম হয় বা একেবারেই থাকে না। তাৎক্ষণিক চিকিৎসক না পেলে বা না দেখানো গেলে বাসায় হালকা গরম পানি ও লবণ দিয়ে কমপক্ষে দিনে তিনবার পাঁচ মিনিট সময় ধরে গরগর করা। তাহলে যেমন গলাব্যথা বা গলা সংক্রমণ ভালো হয়ে যাবে, তেমনি বাতজ্বর হওয়ার ঝুঁকিও থাকবে না।
বিশ্রাম ও বাড়তি সতর্কতা
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত বিভিন্ন ওষুধ খেতে হবে। পাশাপাশি ব্যথা এবং রোগের অন্যান্য উপসর্গ ভালো না হওয়া পর্যন্ত রোগীকে প্রয়োজনে কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর্যন্ত পূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে।
বাতজ্বর হলে কি গর্ভধারণ করা যায়?
মেয়েদের বাতজ্বর হলে বিয়ে বা সন্তান ধারণে অসুবিধা নেই। গর্ভধারণ করলেও ওষুধ বা পেনিসিলিন চালিয়ে যেতে হবে।
এতে সন্তানের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে বাতজ্বরজনিত হৃদ্রোগ গুরুতর হলে সন্তান নেওয়া মায়ের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাই বাতজ্বরজনিত হৃদ্রোগীরা গর্ভধারণের আগে বাতজ্বরে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
উপসর্গ ভালো হলেই কি ওষুধ বন্ধ করা যাবে?
উপসর্গ ভালো হয়ে গেলে বাতজ্বরের প্রতিষেধক চিকিৎসা বন্ধ করা সঠিক নয়। বাতজ্বর একবার হলে বারবার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই বাতজ্বরে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শমতে নিয়মিত ও ক্রমাগত ওষুধ ব্যবহার করতে হবে, যাতে পুনরায় বাতজ্বর না হয়। মনে রাখবেন, এই ওষুধ গ্রহণ বাতজ্বরের আগে আক্রমণের জন্য নয়। এটি ভবিষ্যতে বাতজ্বর না হওয়ার জন্য কাজ করে।
বাতজ্বর কি ছোঁয়াচে রোগ?
বাতজ্বর ছোঁয়াচে রোগ নয়। বাতজ্বরের রোগীর সঙ্গে থাকলে, খেলে, ঘুমালে, এমনকি ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করলেও বাতজ্বর হওয়ার আশঙ্কা নেই। গর্ভাবস্থায় মায়ের থেকে গর্ভের শিশুর সংক্রমণের আশঙ্কা নেই।
0 Comments