উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায়
স্বাভাবিক রক্তচাপ হল সেই বল, যার সাহায্যে রক্ত শরীরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছায়। রক্তচাপের কোনো একক নির্দিষ্ট মাত্রা নেই।
বিভিন্ন বয়সের সঙ্গে ,সঙ্গে একেকজন মানুষের শরীরে রক্তচাপের মাত্রা ভিন্ন এবং একই মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে স্বাভাবিক এ রক্তচাপও বিভিন্ন রকম হতে পারে। উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা, অধিক পরিশ্রম ও ব্যায়ামের ফলে রক্তচাপ বাড়তে পারে। ঘুমের সময় এবং বিশ্রাম নিলে রক্তচাপ কমে যায়। রক্তচাপের এ পরিবর্তন স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে পড়ে। অধিকাংশ সময় রক্তচাপটা স্বাভাবিক মাত্রার ভেতরই থাকে। সাধারণত বয়স যত কম, রক্তচাপও তত কম হয়। যদি কারো রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি হয় এবং অধিকাংশ সময় এমনকি বিশ্রামকালীনও বেশি থাকে, তবে ধরে নিতে হবে, তিনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী।
• উচ্চ রক্তচাপ কি কোনো জটিল ব্যাধি
উচ্চ রক্তচাপ ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের কোনো প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যায় না। নীরবে উচ্চ রক্তচাপ শরীরের বিভিন্ন অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ জন্যই উচ্চ রক্তচাপকে ‘নীরব ঘাতক’ বলা যেতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত এবং চিকিৎসাবিহীন উচ্চ রক্তচাপ থেকে মারাÍক শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
• উচ্চ রক্তচাপ হলে কী, কী জটিলতা হতে পারে
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ চারটি অঙ্গে মারাত্মক ধরনের জটিলতা হতে পারে। যেমন- হৃৎপিণ্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক ও চোখ।
• কী ,কী কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয়
৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না, একে প্রাইমারি বা অ্যাসেন্সিয়াল রক্তচাপ বলে। কিছু, কিছু বিষয় উচ্চ রক্তচাপের আশংকা বাড়ায়, যা নিম্নরূপ-
• বংশানুক্রমিক :
উচ্চ রক্তচাপের বংশগত ধারাবাহিকতা আছে, যদি বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তবে সন্তানেরও উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশংকা থাকে।
• ধূমপান :
ধূমপায়ীদের শরীরে তামাকের নানারকম বিষাক্ত পদার্থের প্রতিক্রিয়ায় উচ্চ রক্তচাপসহ ধমনি, শিরার নানারকম রোগ ও হৃদরাগ দেখা দিতে পারে।
• অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ :
খাওয়ার লবণে সোডিয়াম থাকে, যা রক্তের জলীয় অংশ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তের আয়তন বেড়ে যায় এবং রক্তচাপও বেড়ে যায়।
• অধিক ওজন এবং অলস জীবনযাত্রা :
যথেষ্ট পরিমাণে ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম না করলে শরীরে ওজন বেড়ে যেতে পারে। এতে হৃদযন্ত্রকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় এবং এর ফলে অধিক ওজনসম্পন্ন লোকদের উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে।
• অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস :
অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার, যেমন- মাংস, মাখন ও ডুবোতেলে ভাজা খাবার খেলে ওজন বাড়বে। ডিমের হলুদ অংশ এবং কলিজা, গুর্দা, মগজ এসব খেলে রক্তে কলেস্টেরল বেড়ে যায়। রক্তে অতিরিক্ত কলেস্টেরল হলে রক্তনালির দেয়াল মোটা ও শক্ত হয়ে যায়। ফলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।
• অতিরিক্ত মদ পান :
যারা নিয়মিত অত্যধিক পরিমাণে মদপান করে, তাদের উচ্চ রক্তচাপ বেশি হয়।
• ডায়াবেটিস :
বয়সের সঙ্গে ,সঙ্গে ডায়াবেটিস রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়।
• অতিরিক্ত উৎকণ্ঠা :
অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভীতি এবং মানসিক চাপের কারণেও রক্তচাপ সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে। কিছু ,কিছু রোগের কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে একে বলা হয় সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন। এ কারণগুলোর মধ্যে কয়েকটি হল-
কিডনির রোগ, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ও পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার, ধমনির বংশগত রোগ, গর্ভধারণ অবস্থায় অ্যাকলাম্পসিয়া ও প্রি-অ্যাকলাম্পসিয়া হলে, অনেক দিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ির ব্যবহার, স্টেরয়েডজাতীয় হরমোন গ্রহণ এবং ব্যথানাশক কিছু, কিছু ওষুধ খেলে।
• উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমাতে কী করা উচিত
জীবনযাত্রার পরিবর্তন এনে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
• অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে :
খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। একবার লক্ষ্য অনুযায়ী ওজনে পৌঁছলে সীমিত আহার করা উচিত এবং ব্যায়াম অব্যাহত রাখতে হবে। ওষুধ খেয়ে ওজন কমানো বিপজ্জনক। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওজন কমানোর ওষুধ না খাওয়াই ভালো।
• খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা :
কম চর্বি ও কম কলেস্টেরলযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন- খাসি বা গরুর মাংস, কলিজা, মগজ, গিলা, গুর্দা, ডিম কম খেতে হবে। বেশি আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করা ভালো।
• লবণ নিয়ন্ত্রণ :
তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে
• মদপান :
মদপান পরিহার করতে হবে।
• নিয়মিত ব্যায়াম :
সকাল-সন্ধ্যা হাঁটাচলা, সম্ভব হলে দৌড়ানো, হালকা ব্যায়াম, লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার ইত্যাদি।
• ধূমপান বর্জন :
ধূমপান অবশ্যই বর্জনীয়। ধূমপায়ীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন। তামাক পাতা, জর্দা, গুল লাগানো ইত্যাদিও পরিহার করতে হবে।
• ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ :
যাদের ডায়াবেটিস আছে, তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
• মানসিক ও শারীরিক চাপ সামলাতে হবে :
নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো ঘুমানো, শরীরকে অতিরিক্ত ক্লান্তি থেকে বিশ্রাম দিতে হবে।
• রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা :
নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রক্তচাপ পরীক্ষা করানো উচিত।
• উচ্চ রক্তচাপ হলে কী চিকিৎসা করাতেই হবে
উচ্চ রক্তচাপ সারে না, একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর জন্য নিয়মিত ওষুধপত্র সেবন করতে হবে। কোনোক্রমেই চিকিৎসকের নির্দেশ ছাড়া ওষুধ সেবন বন্ধ করা যাবে না। অনেকেই আবার উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত জানার পরও ওষুধ খেতে অনীহা প্রকাশ করেন। কেউ, কেউ এমনও ভাবেন যে উচ্চ রক্তচাপ তার দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহে কোনো সমস্যা করছে না বা রোগের কোনো লক্ষণ নেই, তাই উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতে চান না। এ ধারণাটাও সম্পূর্ণ ভুল। এ ধরনের রোগীরাই হঠাৎ হৃদরাগ বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, এমনকি মৃত্যুও হয়ে থাকে।
উচ্চ রক্তচাপকে তেমন গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঘটনা দিনদিন বাড়ছে। এসব এড়ানো কিন্তু কঠিন নয়। ওষুধ ছাড়াও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কীভাবে? দেখুন .
রেডিমেড খাবার এড়িয়ে চলুন
রান্নার সময় বাঁচানো, আধুনিকতা বা স্বাদ পরিবর্তন- যে কারণেই হোক না কেন, তৈরি খাবারের প্রতি আজকাল অনেকরই ভীষণ আগ্রহ। অথচ রেডিমেড খাবারে থাকে প্রচুর লবণ, যা রক্তের চাপ বাড়ায়। এ কারণে শুধু হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক নয়, কিডনি কিংবা ডিমেনশিয়ার মতো রোগও হতে পারে। তাই ঘরের রান্না খাওয়াই শ্রেয়।
1. উচ্চ রক্তচাপ কমাতে পটাসিয়ামযুক্ত খাবার
অনেকে ধরেই নেন যে, উচ্চ রক্তচাপ হলেই ট্যাবলেট সেবন করতে হবে। তা সব সময় সত্য নয়। আলু, মিষ্টি আলু, কলা মটরশুঁটি, কসমিস, আলুবোখারা, টমেটো ইত্যাদি পটাসিয়ামযুক্ত খাবার খেলে রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের নর্থওয়েষ্টটার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষা থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
2. কোকোযুক্ত কালো চকলেট
চকলেটপ্রেমীরা কোকোযুক্ত কালো চকলেট খেতে পারেন, তবে চকলেটে কোকোর পরিমাণ কমপক্ষে শতকরা ৭০ ভাগ থাকা উচিত। তবে হ্যাঁ, চকলেট কিন্তু দুটোর বেশি নয়! এতে ওজন বাড়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ, অতিরিক্ত ওজন ধমনীর রক্তের চাপ বাড়ার বড় কারণ। এই তথ্য পাওয়া গেছে জার্মনির কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ে করা এক গবেষণা থেকে ।
3. জবাফুলের চা
দিনে দুই থেকে তিন লিটার পানি নিয়মিত পান করলেও কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ কমে, বিশেষ করে প্লেন পানি ও ভেষজ চা। জানান,, জার্মানির এর প্রধান ডা. মার্টিন।
4. লাল বিটের রস ও ভেষজ চা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে
ভেষজ চায়ের উদ্ভিজ্জ পদার্থ, ফেনোলিক এসিড রক্তচাপ কমিয়ে আনতে বিশেষভাবে সহায়তা করে। বোস্টনের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ে করা এক সমীক্ষায় পাওয়া গেছে এই তথ্য। আরো জানানো হয়, ট্যাবলেট ছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ কমাতে বিশেষভাবে কার্যকর লাল বিটের রস বা জুস।
5. শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট কম, সয়াবিন বেশি
ভাত, নুডলস বা এ ধরনের শর্করা জাতীয় খাবারের পরিবর্তে বেশি করে সয়াবিন খাওয়া উচিত। খাওয়া যেতে পারে টোফু বা দুধের জিনিস। আমেরিকার স্বাস্থ্যবিষয়ক ম্যাগাজিন সার্কুলেশন জানাচ্ছে এই তথ্য।
6. স্ট্রেসকে না বলুন
মানসিক চাপের কারণে শরীরে পেশীগুলোতেও চাপের সৃষ্টি হয়। এর ফলে রক্তের চাপ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও বাড়ে। তাই দিনে অন্তত দুইবার পাঁচ মিনিট করে যেকোনো ধরনের হালকা ব্যায়াম, ইয়োগা বা মেডিটেশন এবং হাঁটাহাঁটি করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
7. পছন্দের মিউজিক শুনুন
ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছেন, পছন্দের গান, বিশেষ করে উচ্চাঙ্গ সংগীত বা ,বা হালকা কোনো মিউজিক উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। তা ছাড়া নিজে গান গাইতেও পারেন। সবচেয়ে বড় কথা, মিউজিকটি হতে হবে নিজের পছন্দের। তবেই কেবল সুফল পাওয়া সম্ভব।
8. নাক ডাকা রক্তচাপ বাড়ায়
জার্মানিতে প্রতি চারজনের একজন নারী এবং প্রতি দুজনের মধ্যে একজন পুরুষ রাতে ঘুমের সময় নাক ডাকে। নাক ডাকার সময় অক্সিজেন আসা যাওয়া বাধাগ্রস্ত হলে স্ট্রেস হরমোন নির্গমন বেশি হয়। এর ফলে ধমনীতে রক্তের চাপ বেড়ে যায়। কারো নাক ডাকার সমস্যা থাকলে তা অবহেলা না করে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
0 Comments